শেখ হাসিনার পতনকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলছে আওয়ামী লীগ

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

নিউজ ডেস্ক

০৭ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৪ পিএম

আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর এক বছর পরও তাদের সরকারের পতনের ঘটনাকে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। দলটির বক্তব্য, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ আরও ভরসা করছে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার ওপর। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ সরকারের ব্যর্থতা দলটির রাজনীতিতে ফেরার পথ সহজ করছে বলে দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন। তবে জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনে দমননীতি চালানো ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগের অনুশোচনা প্রকাশের কোনো ইঙ্গিত এখনো নেই। এ নিয়ে রাজনীতিতে সমালোচনা রয়েছে।


এনসিপির ২১৭ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাড়ে ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসনামলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার অহংকারে রাজনীতি বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো এবং এমনকি সাধারণ মানুষকেও ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। দলটি একা হয়ে পড়েছিল। সেই পটভূমিতে পতনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের দমননীতির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এছাড়া বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ যে দলগুলো বর্তমানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারও আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থানে রয়েছে।


৭৬ বছরের আওয়ামী লীগ এবার সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে। কারণ দলটির শীর্ষ নেতাসহ নেতৃত্বের বড় অংশ দেশ ছেড়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে আছেন। দলটির সাবেক মন্ত্রী, এমপিসহ নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ গ্রেপ্তার হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন মামলায় বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন। দেশের ভেতরে থাকা নেতা-কর্মীরাও এক বছরে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। রাজনীতির মাঠে থেকে দলকে সংগঠিত করতে কোনো নেতা এখনো সাহস দেখাতে পারেননি।

প্রশ্ন হচ্ছে, চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভুল স্বীকার বা কোনো অনুশোচনা না করে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার ওপর ভরসা করে দলটির পক্ষে সহসাই ঘুরে দাঁড়ানো কী সম্ভব? আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রতিও মানুষের আস্থার সংকটও রয়েছে, সে ব্যাপারেও তাদের বিকল্প কোনো চিন্তা নেই বলে মনে হয়েছে।

আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, দলটিতে এখনো শেখ হাসিনার একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তার নেতৃত্বেই দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা চলছে। তবে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দলের রাজনীতিতে আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় হয়েছেন। দলটির নেতাদের অনেকের ধারণা, তাদের নেত্রীর নেতৃত্বে সজীব ওয়াজেদ জয়কে সামনে রেখে দলটির ভবিষ্যত পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এখন ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই সরকার আওয়ামী লীগ ও এর মিত্র দলগুলোর এ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ রাখছে না এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন হবে না, এই বক্তব্য নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত দলটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ও দেশের ভেতরে জনমত তৈরির চেষ্টা করবে বলেও এর নেতারা বলছেন। তারা মনে করেন, যেহেতু আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বড় অংকের ভোট আছে, সে কারণে নির্বাচনে তাদের দলকে বাইরে রাখা হলে তা বড় ইস্যু হবে। কিন্তু দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে এখন ব্যাপক তৎপর হলেও মাঠের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান নেই। এমন কঠিন বাস্তবতায় নির্বাচন ঘিরে মাঠে দলটি সক্রিয় হওয়ার কোনো সুযোগ পাবে কি না, এই প্রশ্নও রয়েছে বিশ্লেষকদের।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে গণ-অভ্যত্থানের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সক্রিয় দলগুলো এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠন বিতর্কে জড়িয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। তাদের পাল্টাপাল্টি দাবিতে এক ধরনের বিভক্তিও তৈরি করছে। এই পরিস্থিতিটাকে আওয়ামী লীগ তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে।

দলটি জুলাই-অগাস্টের আন্দোলন দমনের চেষ্টার ক্ষেত্রেও জামায়াত-শিবিরসহ বিভিন্ন পক্ষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিল। আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পরও তারা ঘটনাপ্রবাহকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবেই সামনে আনে। এখন সেই আন্দোলনের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে এর অংশীজনদের বিভক্তির প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ মনে করছে, তাদের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে একদিকে গ্রেপ্তারের আতঙ্ক, অন্যদিকে রাজনীতির মাঠের এখনকার নিয়ন্ত্রক দলগুলোর আক্রমণের ভয়- এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হয়েছে। দেশের অন্তত পাঁচটি জেলার বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পেয়েছে বিবিসি বাংলা।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে চায়। সেজন্যই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ওপর জোর দিচ্ছে। তা নাহলে ভুল স্বীকার করা হবে এবং তখন বিপর্যস্ত দলের নেতা-কর্মীদের হতাশা বাড়বে। যা দলটিকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও সমস্যা আরও বাড়াতে পারে। আসলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভুল স্বীকারের নজির সেভাবে নেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামী অন্তত ১০ জন নেতার বিচার হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য জামায়াত দুঃখ প্রকাশ করেনি বা ক্ষমা চায়নি। এ বিষয়টি বিভিন্ন সময় উদাহরণ হিসেবে আলোচনায় আসে।

দেশের ভেতরে রাজনীতির সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থানে ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগও কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করবে না বলে দলটির একাধিক নেতা বলেছেন। তারা মনে করেন, এখন অনুশোচনা প্রকাশ করা হলে তাদের নেতা-কর্মীদের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যদিও এর নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, তাদের শাসনের পতনের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দমননীতি চালানো ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকা দলের নেতাদের মধ্যে পর্যালোচনা হয়েছে। সেই আন্দোলন সামলাতে সে সময় রাজনৈতিক দিক থেকেও দলটির সরকার একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন আলোচনাও তাদের ভেতরে হয়েছে। কিন্তু সেই ভুল প্রকাশ্যে স্বীকার করার চিন্তা এখনো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের নেই।