নবিকে সাংবাদিক বলা: শব্দের অপপ্রয়োগ

ইসলাম ডেস্ক

১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:২৭ পিএম

সম্প্রতি একজন বক্তা প্রিয় নবীজিকে ‘সাংবাদিক’ অভিধায় অভিহিত করে চরম বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। দেশের ধর্মীয় অঙ্গনে পক্ষে-বিপক্ষে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ ধরনের বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। কিন্তু আমরা কি দেখছি? কিছু মানুষ তার চরম বিরোধিতা করছেন, তাকে গালিগালাজ করছেন। কিছু মানুষ আবার তার পক্ষ নিয়ে যৌক্তিক সমালোচনাকেও প্রত্যাখ্যান করছেন। মূলত এখানে গঠনমূলক সমালোচনাই কর্তব্য।


ফেসবুক ব্যবহারের আদবকেতা

অভিযুক্ত বক্তা বলেছেন, ‘নবী’ শব্দের মূল ‘নাবা’, যার অর্থ সংবাদ; আর নবী অর্থ বার্তাবাহক। নবী যেহেতু আল্লাহর কাছ থেকে বার্তা বহন করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন, তাই এক অর্থে নবীকে সাংবাদিক বলা যায়।’


সত্যিই কি যে কোনো বার্তাবাহককে সাংবাদিক বলা যায়? ডাকপিয়ন তো বার্তা বহন করেন—তাকে কি সাংবাদিক বলা হয়? দূতাবাসের কর্মকর্তাও তার দেশের বার্তা বহন করেন; অ্যাম্বাসেডরকে কি কেউ সাংবাদিক বলে?

কবি কবিতা লেখেন, কবিতায় অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ বার্তা থাকে। গল্পকারের গল্প, ঔপন্যাসিকের উপন্যাস, প্রবন্ধকারের প্রবন্ধ, এমনকি রম্য লেখকদের রচনাতেও পাঠকের জন্য বার্তা থাকে—সেই হিসেবে কি এরা সবাই সাংবাদিক?

সাধারণ মানুষও জীবনে বহু সংবাদ বা বার্তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়। কারও কাছে কোনো সংবাদ পেয়ে অন্যের কাছে পৌঁছে দিলেই যদি কেউ সাংবাদিক হয়ে যায়, তাহলে জগতের প্রতিটি প্রাণীই সাংবাদিক!

মূলত ভাষাতত্ত্বের একটি সাধারণ নিয়ম না বোঝার কারণেই বক্তা এ ধরনের ভ্রান্ত দাবি করেছেন। শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারাই এখানে মূল সমস্যা। অনেক শব্দের আভিধানিক অর্থে ব্যাপকতা থাকে, কিন্তু পারিভাষায় তা একটি নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়। এমন ক্ষেত্রে শব্দটিকে তার ব্যাপক অর্থে নয়, বরং বিশেষ অর্থেই গ্রহণ করতে হয়।

পারিভাষা বাদ দিয়ে অভিধান থেকে অর্থ নিতে গেলে ভাষার নিয়ম ভেঙে যাবে। বিশেষত ধর্মীয় পরিভাষার ক্ষেত্রে এই নিয়ম ভাঙলে পুরো ধর্মের ভিতই নড়বড়ে হয়ে যায়। যেমন- ঈমান, ইসলাম, জান্নাত-জাহান্নাম, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, ঈদ—প্রত্যেকটির একটি আভিধানিক অর্থ আছে। কিন্তু এখন এই শব্দগুলোকে আভিধানিক অর্থে গ্রহণের অবকাশ নেই; পারিভাষিক অর্থেই এই শব্দগুলোকে গ্রহণ করতে হবে।

ইমান অর্থ বিশ্বাস, কিন্তু সব বিশ্বাসকে কি ইমান বলা যাবে?

ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ, কিন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে আত্মসমর্পণ করলে সেটাকে কি ইসলাম বলা যাবে?

নামাজের মূল ‘নমো’, হিন্দুদের পূজায় ‘নমো নমো’ বলা হয়—তা কি নামাজ?

রোজা মানে উপোস থাকা—যে কোনো উপোস থাকা কি রোজা হবে?

হজ অর্থ ইচ্ছা—যে কোনো ইচ্ছাকে কি হজ বলা যাবে?

জান্নাত অর্থ বাগান, জাহান্নাম অর্থ আগুন—যে কোনো বাগান বা আগুনকে কি জান্নাত-জাহান্নাম বলা যায়?

ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও প্রতিদিনের ব্যবহারে আমরা এ ধরনের উদাহরণ পাই।

জন্তু বা জানোয়ার শব্দের মূল অর্থ প্রাণী, কিন্তু এটি মানুষের ক্ষেত্রে বাংলায় গালির অর্থে ব্যবহৃত হয়।

মানুষও তো প্রাণী—তবু কোনো ভদ্রলোককে ‘জানোয়ার’ বলা যায় না।

ঢাকা একটি শহরের নাম, কিন্তু ঢেকে থাকা কোনো বস্তুকে ‘ঢাকা শহর’ বলা কতটা হাস্যকর!

কাফের শব্দের শাব্দিক অর্থ অস্বীকারকারী, কিন্তু যে কোনো অস্বীকারকারীকে কি কাফের বলা যায়?

আমাদের চারপাশের এবং প্রতিদিনের ব্যবহারের এমন অসংখ্য শব্দ নিয়ে ভাবলেই বিষয়টি আমরা সহজে বুঝতে পারি।

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার গুরুত্ব বা মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে মহানবীকে (সা.) সাংবাদিক বানানোর প্রয়োজন নেই। অসংখ্য আয়াত ও হাদীস দ্বারাই তা প্রমাণ করা সম্ভব। তবে কেবল এই বক্তব্যের কারণে ওই বক্তাকে কাফের সাব্যস্ত করাও অতিরঞ্জন। এমন অতিরঞ্জন আমাদের দেশের ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বেড়েই চলেছে—এই অবস্থা সত্যিই দুঃখজনক।